পুলিশের দাবী আইন অমান্য করলেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে

কাপ্তাই রাস্তার মাথা : গ্রাম সিএনজি থেকে বছরে তিন কোটি টাকা চাঁদা শ্রমিক নেতাদের পকেটে

Passenger Voice    |    ০২:৩৬ পিএম, ২০২২-১১-১৪


 কাপ্তাই রাস্তার মাথা : গ্রাম সিএনজি থেকে বছরে তিন কোটি টাকা চাঁদা শ্রমিক নেতাদের পকেটে

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ চট্টগ্রামের কাপ্তাই রাস্তার মাথায় সিএনজি অটোরিক্সা থেকে শ্রমিক কল্যানের নামে বছরে প্রায় পৌনে তিন কোটি টাকা চাঁদা তুলে ভাগ বাটোয়ারা করছে শ্রমিক নেতারা। শ্রমিক কল্যানের নামে এসব টাকা উত্তোলন করলেও নাম মাত্র শ্রমিক কল্যানে ব্যয় করে অবশিষ্ট অর্থ নেতাদের পকেটে চলে যায়। 

পরিবহন শ্রমিক নেতা আজাদের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় গ্রাম সিএনজি থেকে প্রতিদিন আদায় হচ্ছে প্রায় দেড় লাখ টাকার চাঁদা। প্রশাসনের যোগসাজসে প্রতিটি সিএনজি অটোরিক্সা থেকে দৈনিক ৩০ টাকা হারে এসব চাঁদা উত্তোলন করা হয়ে থাকে। উত্তর এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রায় দেড় হাজার বৈধ অবৈধ সিএনজি অটোরিক্সা জমায়েত হয় এই এলাকায়। চট্টগ্রামের বোয়ালখালি এবং রাউজান, রাঙ্গুনিয়া ও কাপ্তাই এলাকার বৈধ অবৈধ প্রায় দেড় হাজার সিএনজি অটোরিক্সা এখান থেকে যাত্রী নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছাড়ে।

এ ছাড়া এসব সিএনজি অটোরিক্সা থেকে ভর্তি বাবদ নেয়া হয়ে থাকে ৬০০ টাকা করে। এ হিসেবে দেড় হাজার সিএনজি থেকে আয় হয় মাসে প্রায় ৯ লাখ টাকা। দৈনিক এবং মাসিক দুই খাতে মিলিয়ে এসব গ্রাম সিএনজি থেকে বছরে আয় হচ্ছে প্রায় পৌনে তিন কোটি টাকা। যার সিংহ ভাগই চলে যায় শ্রমিক নেতাদের পকেটে।

উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্যতম প্রবেশদ্বার ব্যস্ততম কাপ্তাই রাস্তায় গ্রাম সিএনজি অটোরিক্সার দৌরাত্মে অতিষ্ঠ সাধারন মানুষসহ এ সড়কে চলাচলকারীরা। পরিবহন শ্রমিক নেতা হারুনের ছত্রছায়ায় কাপ্তাই রাস্তার মাথা হয়ে উঠেছে গ্রাম সিএনজি অটোরিক্সার অঘোষিত স্টেশনে। দেখলে মনে হবে এটি যেন একটি সিএনজি টার্মিনাল।  প্রতিদিন বৈধ অবৈধ প্রায় দেড় হাজার গ্রাম সিএনজির দখলে থাকে এ গুরুত্বপূর্ণ সড়কটির প্রবেশমুখ। গ্রাম সিএনজি’র অঘোষিত স্টেশন বনে যাওয়ায় এখানকার সিডিএ স্কুলসহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের চলচলে পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা দেখা যায়, কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকার রেল লাইনের দুই পাশের সড়ক দখল করে দাঁড়িয়ে আছে শত শত গ্রাম সিএনজি অটোরিক্সা। শহরের অতিগুরুত্বপূর্ণ এই প্রবেশ পথে পরিবহনে শৃঙ্খলা রক্ষায় চোখে পড়েনি কোন ট্রাফিক পুলিশকে। লাঠি হাতে ৩০/৩৫ জন যুবককে দেখা গেছে সিএনজির সিরিয়াল মেইনটেইন করতে। রয়েছে নির্ধারিত লাইন ম্যান খ্যাত চাঁদা উত্তোলন কারীও। তারা এসব সিএনজি থেকে আদায় করে সিরিয়ালের নামে দৈনিক ৩০ টাকা করে। আবার তাদের সমিতির আওতার বাইরে কোন গ্রাম সিএনজি এখানে যাত্রী নিয়ে আসলে লাঠি হাতে এসব যুবক দৌড়ে গিয়ে উক্ত সিএনজিকে আটক করে রেল লাইনের পাশে সমিতির নির্ধারিত গ্যারেজ এলাকায় নিয়ে আটকে রেখে তাদের সদস্য হতে বাধ্য করা হয়। এ জন্য আদায় করা হয় ৬০০ টাকা। সদস্য হতে না চাইলে সিএনজি আটকে রাখা হয়। কুয়াইশ সংযোগ সড়ক এলাকায় চলাচলকারী বেশ কয়েকজন সিএনজি চালক অভিযোগ করে বলেন যাত্রী নিয়ে বা গ্যাস নিতে কাপ্তাই রাস্তার মাথায় গেলেই সেখানকার সমিতির সদস্যরা আমাদের সিএনজি আটক করে । বাধ্য হয়ে তাদের দাবীকৃত ৬০০ টাকা পরিশোধ করে সিএনজি ছাড়িয়ে আনতে হয়। না হয় পুলিশ দিয়ে সিএনজি ট্যু করানো হয়। যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এখানকার শ্রমিক নেতারা। 

কাপ্তাই, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান থেকে নগরীতে প্রবেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশমুখ কাপ্তাই রাস্তার মাথা দখল করে আছে গ্রাম সিএনজি অটোরিক্সা। দেখেই মনে হবে এটি যেন স্বীকৃত ট্যাক্সি স্টেশন। অথচ নগরীতে গ্রাম সিএনজি ট্যাক্সি প্রবেশ করার কথা নয়। কাপ্তাই রাস্তার মাথার মুখেই দেখা গেলো নগর ট্রাফিকের লাগানো একটি সাইনবোর্ড। লিখা রয়েছে ‘এক সারিতে পাঁচটি অটো রিকশা পার্কিং, ট্রাফিক বিভাগ, সিএমপি’। মোড়টি সিএনজি ট্যাক্সির দখলে থাকার কারণে পাশেই থাকা সিডিএ গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের আসা যাওয়া করতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

প্রকাশ্যে এসব অনিয়ম চলছে। অথচ কাপ্তাই রাস্তার মাথায় রয়েছে ট্রাফিক ও পুলিশ ফাঁড়ি।
ইস্পাহানি স্কুলের বিপরীতে মোহরা এলাকায় সড়কজুড়ে শত শত গ্রাম সিএনজি ট্যাক্সি পার্কিং করে দাাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয় লোকজন জানান, স্থানীয় দুই আওয়ামী লীগ নেতা গ্রাম সিএনজি ট্যাক্সি স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করেন।

চট্টগ্রাম অটোরিক্সা অটো-টেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের (রেজিঃনং ১৪৪১) সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরীর কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকার সিএনজি অটোরিকশা চলাচল নিয়ন্ত্রন করে যাচ্ছে। দীর্ঘ দিন ধরে এ স্পটে এই সিএনজি অটোরিকশায় চাঁদাবাজী চললেও অদৃশ্য কারনে নিরব ভুমিকায় ট্রাফিক পুলিশ ।

শ্রমিক নেতা ও ট্রাফিক পুলিশের নামে মাসিক চাঁদার বিনিময়ে চট্টগ্রাম জেলা এলাকার নিবন্ধিত প্রায় দেড়  হাজার এর অধিক সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করছে নগরীর কাপ্তাই রাস্তার মাথা ও কালুরঘাট পর্যন্ত। নগরীর প্রবেশ মুখ গুলোতে যানজট হ্রাস করতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক পুলিশ কমিশনার মাহবুবুর রহমান এক বিশেষ উদ্যোগ নিলেও তাঁর বদলির পর ট্রাফিক পুলিশ ও সিএনজি নেতাদের যোগসাজসের কারনে কাপ্তাই রাস্তার মাথার নৈরাজ্য বন্ধ করার চেষ্টা করেও তিনি পারেন নি।

প্যাসেঞ্জার ভয়েসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে , চট্টগ্রাম জেলার নজুমিয়ারহাট, গোলাপের দোকান হয়ে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ এর মতো গ্রাম সিএনজি অবৈধভাবে ঢুকে পরছে শহরের অন্যতম প্রবেশ মুখ কাপ্তাই রাস্তার মাথায়। অন্যদিকে বোয়ালখালী থেকে কর্ণফুলী নদী হয়ে শহরের কালুরঘাট ও কাপ্তাই রাস্তার মাথা পর্যন্ত প্রতিদিন চলাচল করছে ৭০০ এর অধিক গ্রাম সিএনজি। শহরে চলাচলের পারমিটবিহীন এই গাড়িগুলোকে স্থানীয় পুলিশের মাসিক মাসহারার টোকেন নিতে হয় ৫৫০ টাকা করে।

কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় চট্টগ্রাম অটোরিক্সা অটো-টেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের (রেজিঃনং ১৪৪১) এ শাখার অধীনে এক হাজার সিএনজি থাকার কথা স্বীকার করেছেন সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জাফর ইকবাল। তবে সংগঠনের সভাপতি মো. আজাদ বলেন সংগঠনের আওতায় মাত্র ২৫০ থেকে ৩০০ সিএনজি রয়েছে। তিনি বলেন, যারা সমিতির সদস্য হতে চায় তাদেরও কাছ থেকে ৫০০ টাকা করে নেয়া হয়। আর দৈনিক নেয়া হয় প্রতি সিএনজি থেকে ৫ টাকা করে। তবে প্যাসেঞ্জার ভয়েসের অনুসন্ধান বলছে একটি সিএনজি প্রতিদিন ৬/৭ ট্রিপ ভাড়া হাঁকান। ৬ ট্রিপ হিসাব করলেও দেখা যায় প্রতি সিএনজি থেকে এক ট্রিপে ৫ টাকা করে ৬ ট্রিপে নেয়া হয় ৩০ টাকা। তিনি বলেন উত্তোলিত টাকা শ্রমিকদের মৃত্যু পরবর্তী সহায়তাসহ দুর্ঘটনা জনিত সহায়তার কাজে ব্যয় করা হয়। যদিও গত এক বছরে এ ধরনের কতজন শ্রমিককে সহায়তা দেয়া হয়েছে তার সঠিক হিসেব দিতে পারেননি তিনি। তবে স্থানীয়দের ম্যানেজ করে এসব সিএনজি এখানে স্টেশন গড়েছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম অটোরিক্সা অটো-টেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, আমরা সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি গাড়ি থেকে পাঁচ টাকা চাঁদা নিয়ে থাকি। গাড়িগুলো প্রতি মাসে ৫৫০ টাকার টোকেন দিয়ে চলাচলের বিষয়টা সত্য।

এ ব্যাপারে কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক (টিআই) মোশারফ হোসেন প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, বোয়ালখালি থেকে কিছু গ্রাম সিএনজি গ্যাস নেয়ার জন্য আসে সেগুলোকে আমরা ছাড় দিই। এ ছাড়া রাউজান রাঙ্গুনিয়া বা কাপ্তাই এলাকার গ্রাম সিএনজি রাস্তার মাথার রেললাইন অতিক্রম করলেই আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করি। প্রতিদিনই আইন অমান্য করার অপরাধে সিএনজি অটোরিক্সা আটক করাসহ মামলা দেয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান। এ ছাড়া ট্রাফিক পুলিশের নাম ভাঙ্গিয়ে শ্রমিক নেতাদের চাঁদা আদায়ের বিষয়ে তিনি কিছু অবগত নন বলে জানান। 

সূত্র বলছে, চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ট্রান্সপোর্ট কমিটির নিয়মানুযায়ী মহানগরী এলাকায় সিএনজি ট্যাক্সি চলাচলের নির্দেশনা রয়েছে ১৩ হাজার। কিন্তু অতিরিক্ত পাঁচ হাজারেরও বেশি গ্রাম সিএনজি টেক্সি চলাচল করছে যা সম্পূর্নভাবে অবৈধ। 


পিভি/জেএম/ডেস্ক